হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ: কিছু স্মৃতি কিছু কথা (চতুর্থ পর্ব)
বলেছিলাম এই পর্বে কৃতি শিক্ষকদের নিয়ে লিখব। তাই শুরুতেই শিক্ষকদের নিয়েই লিখা শুরু করছি। অধ্যক্ষ আব্দুর রব সাহেবের সময়ে হাজীগঞ্জ কলেজের শিক্ষক হিসেবে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তারা হলেন মাকসুদুর রহমান খান, আ ন ম মফিজুল ইসলাম, নাজমা আক্তার ও শাহজাহান সরকার। এই চারজন এখনো কলেজে আছেন।
অধ্যক্ষ মহিউদ্দিন সাহেবের সময়ে বেশ কিছু শিক্ষক নিয়োগ পান। তাদের মাঝে শ্রী কৃষ্ণ দে, বেলাল হোসেন, তোহিদা আকতার, লোকমান হোসেন, বিলকিস আরা অন্যতম। এই সময়ে আরো দুজন নিয়োগ পেয়েছিলেন। তারা হলেন সেলিনা আক্তার ও মোখলেসুর রহমান। মোখলেসুর রহমান অল্প কিছুদিন এখানে কর্মরত ছিলেন এবং তার স্ত্রী সেলিনা আক্তার দীর্ঘ ১৫ বছর অধ্যাপনা করে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। বাকীরা সবাই এখনো এই কলেজে কর্মরত আছেন। ব্যক্তিগত ভাবে আমি উল্লেখিত শিক্ষকদের কাছে অনেক ঋণী। আমার সন্তানদের উচ্চশিক্ষা লাভের পিছনে তাদের অবদান পারিবারিক ভাবেই আমরা আজীবন স্মরণে রাখব। দীর্ঘদিনের সহকর্মী হিসেবে উল্লেখিত শিক্ষকগণ কোনদিন ও আমি তাদেরকে বলেছি কিন্তু তারা আমার কথা রাখেনি এমন ঘটনার নজির নেই। তা কলেজের স্বার্থেই হোক বা ব্যক্তিগত স্বার্থে।
বিজ্ঞান বিভাগের আজকের এই সমৃদ্ধি, মেধাবী ছাত্র ভর্তি এবং ভাল ফলাফল এই সব কিছুর পিছনেই তাদের ভূমিকা ছিল প্রসংশনীয়। মেধাবী ছাত্র ভর্তি প্রসঙ্গে আমার নিজের দু-একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। আমার এলাকার সাদ্দাম নামের একজন মেধাবী ছাত্র রামপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ প্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। সৈয়দপুরের ঐ পরিবারটি ই ছিল একটি মেধাবী পরিবার। তার বাবা রামপুর স্কুলের একজন শিক্ষক ছিলেন। ঐসময় প্যারালাইজড হয়ে বাড়িতে শয্যাশায়ী। আমি একাই একদিন গেলাম। আলোচনার এক পর্যায়ে জানতে পারলাম সাদ্দাম কে তারা চাঁদপুর কলেজে ভর্তি করাবে। ভর্তি ফরম সংগ্রহ এবং ছেলেটিকে তার খালার বাসায় রেখে পড়ানোর সিদ্ধান্ত তারা চূড়ান্ত করে ফেলেছে। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। এ ব্যাপারটিকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করলাম।
আলোচনার এক পর্যায়ে আমি দেখতে পেলাম সাদ্দামের মা আমার আপ্যায়নের জন্য ভিতরের কক্ষে বসে কিছু ফল কাটছেন। আমি ওসমান ভাই এর মাথার পাশে বসে ভাবী কে উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করলাম,” ভাবী সাদ্দাম আপনার ছোট সন্তান, ছোট মানুষ। আপনারা বাড়িতে থাকবেন আর আপনার এই ছোট সন্তানটি চাঁদপুরে থাকবে। একসময় আপনি একটি ইলিশ মাছ অথবা একটি ফজলি আম যখন ই কাটতে যাবেন তখনই আপনার সন্তানের কথা মনে পড়ে যাবে। মনে মনে ভাববেন, আজকে জানি সাদ্দাম কি দিয়ে ভাত খেলো।” এভাবে অনেক কথা….। এক পর্যায়ে আমি দেখতে পেলাম সাদ্দামের মায়ের দু চোখ ছলছল করছে । এমনি সময় সাদ্দামের বাবা হঠাৎ করে বলে উঠলেন,” চৌধুরী সাহেবের কথাই সঠিক। সাদ্দামকে আপনার হাতে তুলে দিলাম।” পরদিন হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে সে ভর্তি হল। আজ সেই সাদ্দাম চুয়েট থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নিয়ে KSRM এর মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার। তার জন্য আমি গর্বিত।
তারপরের ঘটনা, উয়ারুক হাই স্কুল থেকে একটি ছেলে এসএসসি তে ৪.৮১ পেয়ে পাশ করে হতশায় হাবুডুবু খাচ্ছিল। এমনি সময়ের একদিন আমি, জহির স্যার, কালাম স্যার, জব্বার সাহেব এবং স্বপন পাল সহ তাদের বাড়িতে উপস্থিত হই।
এ প্লাস না পাওয়াতে ছেলেটি বড়ই হতাশ। তার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। এখন তা আর সম্ভব নয়। আমি তাকে বোঝাতে লাগলাম, “ডাক্তার হতে পারবেনা তাতে কি? এসএসসি তে এ প্লাস পাও নাই তাতে কি? তুমি এইচএসসি তে এ প্লাস পাবা। তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, কলেজের প্রফেসর, ম্যাজিস্ট্রেট, ব্যারিস্টার, বিচারপতি হওয়ার সুযোগ তো আছে। ” এভাবে বলার পরে ছেলেটি আমার কথায় আশ্বস্ত হয়ে দুইদিন পর সে কলেজে এসে ভর্তি হয়। তাকে আমরা লেখাপড়ার ব্যাপারে সম্ভাব্য সকল প্রকার সহযোগিতা করি। সে ও আমাদেরকে নিরাশ করে নি। এইচএসসির ফলাফলে আমার মুখের কথার জয় হয়। ছেলেটি এ প্লাস পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সুযোগ পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে সে বিসিএস (শিক্ষা) এ উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে রামগঞ্জ সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করছে। ছেলেটি আর কেউ না, আমার প্রিয় মেহেদি।
আরেকদিনের ঘটনা, মেহেদির বাড়িতে যেদিন আমরা গিয়েছিলাম সেদিন অনেক যায়গায় ঘুরাঘুরি করে বিকেল বেলা উয়ারুক বাজারে এসে কিছু খেতে বসি।খাওয়ার এক পর্যায়ে প্রফেসার কালাম সাহেব বললেন,” বাজারের উত্তর পাশে পাটোয়ারী বাড়ি। সেই বাড়ির একটি মেয়ে এ প্লাস পেয়েছে। চলেন আমরা সেখানে যাই।” আমাদের সাথের অধিকাংশই সেখানে যাওয়ার জন্য সায় দেয় নি। কিন্তু আমার পীড়াপীড়িতে সবাই সম্মত হলে আমরা পাটোয়ারী বাড়িতে উপস্থিত হই।
ঘরে ঢুকেই জানতে পারলাম মেয়েটির বাবা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। মেয়েটি বাড়িতেই ছিল। তার বড় বোন বাবার সেবা শুশ্রূষা করছিল। এক পর্যায়ে বাবার কক্ষে আমাকে যাওয়ার জন্য সবাই অনুরোধ করায় আমি ঐ কক্ষে একাই গেলাম এবং ধীরে সুস্থে আমাদের অভিপ্রায়ের কথা বলতে লাগলাম। আমার কথায় এক পর্যায়ে অসুস্থ পিতা আশ্বস্ত হয়ে ভাঙা কন্ঠে বলে উঠলেন,” আপনার কথা ঠিক। ইনশাআল্লাহ আমার মেয়ে আপনাদের কলেজেই ভর্তি হবে।” পরদিন মেয়েটি তার বড় বোন কে নিয়ে কলেজে আসে এবং ভর্তি হয়। সে এইচএসসিতেও এ প্লাস পেয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মেসি বিভাগ হতে ডিগ্রি নিয়ে বর্তমানে আমেরিকায় আছে। মেয়েটির আমাদের সবার প্রিয় তামান্না আকতার।
অন্য একদিনের ঘটনা, আমি বোগদাদ বাসে করে কুমিল্লা হতে হাজীগঞ্জ আসছিলাম। কালিয়াপাড়া পর্যন্ত বাসে অর্ধেক পরিমান যাত্রী ছিল। আমার পাশের আসনটি কালিয়াপাড়া পর্যন্ত খালি ছিল। দোয়াভাঙ্গা এসে পৌছালে ছেলে বয়সী একজন যাত্রী বাসে উঠে। সে আমার সিট অতিক্রম করে পেছনের দিকে গেলে আমি তাকে আমার পাশে বসতে বলি। ছেলেটির কাঁধে একটি ব্যাগ ছিল। হাজীগঞ্জ পর্যন্ত তার সাথে আমার কোন বাক্যবিনিময় হয়নি। বোগদাদের কন্ডাকটর বাস পূর্ব বাজার ব্রিজের উপর থাকতেই “হাজীগঞ্জ হাজীগঞ্জ” বলে নামতে বলায় কয়েকজন যাত্রীর সাথে পাশে বসা ছেলেটিও নেমে পড়ে।
আমি পশ্চিম বাজার এসে একটি রিকশা নিয়ে কলেজে আসি। স্টাফ রুমে কিছুক্ষণ বসার পর হিসাব বিজ্ঞানের সেলিম সাহেব ঐ ছেলেটিকে নিয়ে আমার কাছে আসে এবং বলে,” স্যার, ছেলেটি রাগৈ হাইস্কুল থেকে এ প্লাস পেয়েছে। আপনি তার সাথে একটু কথা বলেন। ” ঐ বছর ও আমি ভর্তি কমিটির আহবায়ক ছিলাম। বিনয়ী ছেলেটি আমাকে দেখেই কাচুমাচু করতে থাকে এবং তার মধ্যে কিছুটা সংকোচবোধ ফুটে উঠে। কারণ ঘন্টাখানেক আগেই তো সে আমার পাশে বসেই দোয়াভাঙ্গা থেকে হাজীগঞ্জ এসেছে। তখন ও তো জানত না যে আমি ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক। আমি তাকে নিশ্চিন্তে মনের ভাব প্রকাশ করতে বলায় সে বলতে লাগল, “আমি হাজীগঞ্জের বেশি কিছু চিনি না। বাড়ি থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি মডেল কলেজে ভর্তি হব। তবে ডিগ্রি কলেজটাও আমি দেখব। প্রথমে আমার মডেল কলেজে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও মনের ভুলে আমি প্রথমে ডিগ্রি কলেজে এসে গেছি।” আমি আমার মেধার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করে অনেক শিক্ষকদের উপস্থিতিতে তার সাথে বিস্তারিত আলাপ করলাম। আমার কথায় ছেলেটি আশ্বস্ত হয়ে বলল,” আমি আর অন্য কোন কলেজে যাব না। ” ঐদিন ই ছেলেটি ভর্তি হয়ে গেল৷ এইচএসসি পরিক্ষায় ছেলেটি বাণিজ্য বিভাগ থেকে এ প্লাস পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার শেষ ভাগে তার সাথে আমার ইউসিসির একটি ইফতার অনুষ্ঠানে দেখা হয়৷ তখন সে ইউসিসির একজন শিক্ষক। ইফতারের পরে তার সাথে আলোচনার এক ফাঁকে সে বলে,”স্যার, বিসিএস দিব। যদি ফরেন ক্যাডারে সু্যোগ পাই তাহলে বাংলাদেশেই থাকব অন্যথায় উচ্চতর ডিগ্রির জন্য বিদেশে চলে যাব।” আমি হতবাক, কিছুদিন আগেও যেই ছেলেটি হাজীগঞ্জ এর কিছুই চিনত না অল্প সময়ের ব্যবধানে তার এত পরিবর্তন। ছেলেটি সত্যিই মেধাবী একজন। সে আমাদের বাণিজ্য বিভাগের গর্বিত ছাত্র এবং আমার প্রিয় ছাত্র। তার নাম কাউসার।
মহিউদ্দিন সাহেবের পরে হাজীগঞ্জ কলেজে যোগদান করেন মেজর অবঃ আব্দুল হাফিজ স্যার। তার সময়ে নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকরা হলেন মোজাম্মেল হোসেন , মোঃ সেলিম (হি.বি), মোঃ ইয়াসিন মিয়া, বজলুর রহমান, শামসুন্নাহার শিরিন, হারুণ এবং এমরান হোসেন।
অধ্যক্ষ মিহির কান্তির সময়ে নিয়োগ প্রাপ্তরা হলেন প্রদিপ কুমার দাস ও আমিনুল ইসলাম। খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যাদের কথা মনে পরে, তাদের মাঝে আরিফুর রহমান পাঠান, জাকির হোসেন ও আবুল হোসেন অন্যতম।
এ পর্যায়ে হাজীগঞ্জ কলেজের ছাত্র রাজনীতি, ছাত্র নেতা ও তাদের অবস্থান সম্পর্কে কিছু আলোচনা করব।
শিক্ষক হিসেবে যোগদানের কিছুদিন পরেই ছাত্র রাজনীতির কিছুটা গন্ধ অনুভব করতে লাগলাম। যা পরবর্তী কালে দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে অনেকটাই কার্যকরী ভূমিকা রাখে। জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি তাদের স্বীয় স্বার্থ রক্ষার্থেও তারা সক্রিয় ছিল। তবে তা কখনোই কলেজ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল না। আশির দশকের ক্রিয়াশীল ছাত্র সংঠনের মাঝে উল্লেখযোগ্য ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রলীগ (জাসদ), কিছু সময়ের জন্য ছাত্র সমাজ অন্যতম ছিল। আজকের এই পর্বে আমি বাংলাদেশ ছাত্র লীগের আশির দশকের ও পরবর্তীকালে আমার অবসর গ্রহনের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত যারা নেতৃত্বে ছিল এবং আজ ও আছে তাদের সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করব।
আগেই বলে রাখি সকল নেতৃবৃন্দের কথা হয়ত এই ছোট পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব হবে না। তাছাড়া স্মরণ শক্তির ও একটি ব্যাপার রয়েছে। মনের অগোচরে যদি উল্লেখযোগ্যদের কেউ বাদ পরে যায় সেজন্য প্রথমেই আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। তার পরেও কেউ যদি স্মরণ করিয়ে দেয় তাহলে পরবর্তী পর্বে তা উল্লেখ করার চেষ্টা করব।
ছাত্রলীগের নেতৃত্বের কথা লিখতে গেলেই প্রথমে আসে আব্দুল মালেক (প্রয়াত), আবুল কালাম (মকিমাবাদ পশ্চিম পাড়া), বাদল, হাবিবুর রুসুল চঞ্চল (প্রয়াত), বিল্লাল হোসেন তারেক (প্রয়াত), গাজী মাঈনুদ্দিন, রায়হানুল হক জনি (কমিশনার), গোলাম ফারুক মুরাদ, হুমায়ুন কবির (খুলনা), জামাল (জিবি সদস্য), আলমগীর (দিগ চার), মাসুদ মজুমদার (আজু ভাইয়ের ছোট ভাই),নাসের, মান্নান, তরুন, জহিরুল ইসলাম মামুন, মিঠুন ভদ্র,কামাল (৩নং কালচোঁ), বকুল, শাহজাহান, সমীর (বলাখাল), টিপু (ইতালী), লিটন পাল, প্রলয় ভদ্র, সৈয়দ আহমেদ খসরু, এ কে আজাদ (৪নং কালচোঁ), ইউসুফ পাটোয়ারী (চেয়ারম্যান), শামসু মুন্সী,মুজিবুর রহমান (বিলবাই), বোরহান মজুমদার, সোহেল মজুমদার, সোহেল, সাদেক মুন্সী সহ আরো অনেকে। শেষোক্ত তিনজন আমার কলেজের শেষ সময়ের বছরগুলোতে কলেজের ক্রীড়া- সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। উল্লেখিত ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের অধিকাংশ ই আজও রাজনীতির অঙ্গনে নেতৃত্বের বলিষ্ঠতায় স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম। উপজেলার আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্বে অনেক ক্ষেত্রেই হাজীগঞ্জ কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের অবস্থান লক্ষণীয়। উল্লেখিত ছাত্র নেতৃবৃন্দের সাথের দু একটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারছি না।
প্রয়াত আব্দুল মালেক আমার অনেক আস্থাভাজন প্রিয় ছাত্র ছিল। শিক্ষকদের সাথে তার আচরণ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। ১০ বছর আগের একটি ঘটনা, আমি বোগদাদের লাস্ট ট্রিপে হাজীগঞ্জ থেকে কুমিল্লা যাচ্ছিলাম। শেষ ট্রিপ তাই বাস যাত্রীতে পরিপূর্ণ ছিল। ড্রাইভারের পেছনের আসনেই মালেক বসা। আমি ভীড় ঠেলে বাসে উঠলেই মালেক দাড়িয়ে যায় এবং বলে, “স্যার আপনি বসেন।” আমি বললাম, ” তুমি বসো, তুমি তো কালিয়াপাড়াতেই নেমে যাবে। আমি তো কুমিল্লা যাব।” কিন্তু সে কিছুতেই আর বসল না। দুজনেই দাড়িয়ে দাড়িয়ে বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলছিলাম, বাস কালিয়াপাড়া আসলে মালেক নেমে যায়, আমি তার সিটেই বসি। কালিয়াপাড়া থেকে বাস ছাড়ার সাথে সাথেই টুপি দাড়ি ওয়ালা বৃদ্ধ ড্রাইভার কন্ডাকটর কে জিজ্ঞেস করল, মালেক ভাইয়ের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছে কিনা। কন্ডাকটর হ্যা সূচক জবাব দিলে ড্রাইভার রেগে যায় এবং বলে উঠে, “মালেক ভাইকে চিনস না? বোগদাদের এই রাস্তায় কত বিপদের সময় উনি আমাদেরকে কতভাবে সাহায্য করেছে। ভবিষ্যতে কোনদিন তার কাছ থেকে ভাড়া নিবি না।” এই কথোপকথন আমি মনোযোগের সহিত প্রত্যক্ষ করলাম। আমি একজন যোগ্য ছাত্র এবং ছাত্র নেতার শিক্ষক। বুকটা গর্বে ঐ মুহুর্তে ফুলে উঠেছিল।
আরেকটি স্মরণীয় ঘটনা, যা আমার কলেজ জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘটনাও বলা যেতে পারে। সেই ঘটনার নায়কদের মাঝে জামাল (জিবি সদস্য), মাসুদ, নাসের (উচঙ্গা) এখনো বেঁচে আছে।দোয়া করি তারা আরো অনেক দিন বেঁচে থাকুক। ঘটনাটি ছিল, কলেজ থেকে ফেরার পথে নৌকা ঘাটে আমাদের কয়েকজন সিনিয়ার শিক্ষকের সাথে ছাত্রদের নৌকা থেকে আগে পরে নামা নিয়ে কিছু কথা-কাটাকাটি হয়। এর একপর্যায়ে অধ্যপক রতন সাহেব রেগে গিয়ে তেড়ে যায়, আমি তাদের পিছনেই ছিলাম। দু এক মিনিটের মাঝেই সব সমাধান হয়ে গেলে আমি বাজারে চলে যাই এবং একাকী উল্কা হোটেলের কেবিনে ভাত খেতে বসি। ঐসময়ে দু চারজন ছাত্র নেতা জামাল-মাসুদ সহ আমার কাছে জানতে চায়, “স্যার, নৌকা ঘাটে কি হয়েছিল?” আমি সব খুলে বলার পর একজন ছাত্র নেতা বলে উঠে, আপনার কথা ও সম্পূর্ণ ভাবে বিশ্বাস করতে পারছি না। একথায় আমি ভিষণ ভাবে আহত হই এবং তাদের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়িতে চলে আসি। রাত ১০ টায় আমি একটি সামাজিক বৈঠকে আমার বাড়ির পশ্চিমে চলে যাই এবং ফিরে আসি রাত আড়াইটায়। ভোর বেলা আমার ঘরের গৃহকর্মী দরজা খুললেই দেখতে পায় চার পাঁচ জন ছাত্র দরজায় দাড়ানো। গৃহকর্মী আমাকে একথা জানালে আমি তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ি এবং দরজায় গিয়ে দেখি জামাল, নাসের ও হুমায়ুন সহ আরো কয়েকজন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ঐ মূহুর্তে শুধু একটি বাক্যই জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তোমরা কখন এসেছো?” জবাবে জামাল বলল, ” রাত ১০ টায় আপনি যখন পশ্চিমে চলে যান তখন আমরা আপনার প্রতিক্ষায় থাকতে থাকতে আপনার বৈঠক খানার ডালের স্তুপের উপর শুয়ে পড়ি। ” তাদের কথা শুনে আমার চোখ অশ্রুসজল হয়ে পড়ে এবং সবাইকে আমি বুকে জড়িয়ে ধরে বলি,” তোমরা আমাকে চিরদিনের জন্য ঋণী করে ফেললে, আর একটি বাক্য ও এ প্রসঙ্গে ব্যয় করবে না।” গৃহকর্মী কে নাস্তার কথা বলে সবাইকে নিয়ে আমি পুকুরের ঘাটলায় গোসল করে ফিরে আসি। তারপর নাস্তা সেড়ে তাদের কে নিয়েই কলেজে আসি। আর তাদের বার বার বলতে থাকি, “আজকের এই ঘটনা আর কারো সাথে বলা যাবে না।” ঐ সময় হয়ত তারা আলাপ করে নি, কিন্তু আজকে তো সেই ঘটনাই আমার কলেজ জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা।
ঐ সময়কার ছাত্র নেতাদের মাঝে যারা ভালো বক্তব্য দিতো, তাদের মাঝে আমার বেশি পছন্দের বক্তা ছিল বিল্লাল হোসেন তারেক এবং পরবর্তীতে গাজী মাইনুদ্দিন ও সৈয়দ আহমেদ খসরু। গোলাম ফারুক মুরাদ আমার অত্যন্ত আস্থাভাজন প্রিয় ছাত্র ছিল। মাসুদ, আলমগীর, জামাল, সমীর এবং লিটন ভদ্র এদেরকে দেখলে মনে হয় আজও তারা আমার ছাত্র। অথচ তাদের সন্তানরাই আজ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যারা নাকি আমার কাছে নাতি ছাত্র হিসেবেই বেশি বিবেচিত।
ছাত্রলীগ থেকে রাজনীতিতে যারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তাদের মাঝে গাজী মাইনুদ্দিন (হাজীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান), গোলাম ফারুক মুরাদ (উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান), ইউসুফ পাটোয়ারী (২ নং বাকিলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান), কবির হোসেন (৬নং বড়কুলের চেয়ারম্যান)। ছাত্রলীগ নেতা, ছাত্র সংসদের দুই বারের নির্বাচিত ভিপি এবং একাধিকবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান জামাল ভুঁইয়া হাজিগঞ্জ কলেজের প্রাক্তন ছাত্র।
রাজনীতির বাইরেও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের ছাত্রদের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। আজকের হাজীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি এবং পূর্ববর্তী দুইবারের সভাপতি মুন্সি মোহাম্মদ মনির হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজেরই প্রাক্তন ছাত্র এবং আমার প্রিয় ছাত্র। পেশাগত ভাবে ইতিমধ্যেই সে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছে। সাংবাদিকতা পেশায় প্রাক্তন ছাত্রদের মাঝে আরো যারা উল্লেখযোগ্য তাদের মাঝে হাসান মাহমুদ, গাজী সালাহউদ্দিন ও মোহাম্মদ হাবিব উল্যাহ অন্যতম। এসএম মিরাজ মুন্সী সাংবাদিকতার পাশাপাশি কলেজ প্রাঙ্গনে সাংস্কৃতিক
অঙ্গনে অভিনেতা ছিল। তাদের সবার কথা আজও আমার চোখে ভাসে এবং মনে পড়ে ৷
আজকের পর্বে যেসকল ছাত্র ও ছাত্র নেতাদের কথা উল্যেখ করলাম তাদের অধিকাংশই সামাজিক এবং রাজনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত। সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ অবিচল থাকবে। স্ব স্ব অবস্থান থেকে তারা সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সহিত দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে এই প্রার্থনা এবং প্রত্যাশা রেখেই চতুর্থ পর্ব শেষ করছি।
ছাত্রদের কথা এখানেই শেষ নয়। আগামী পর্বে মুক্তিযুদ্ধ, ছাত্রদল সহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠন এবং কৃতি ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে আরো কিছু কথা উপস্থাপন করবো।