শুক্রবারের গল্প
সকাল প্রায় ১১টা। বাসা থেকে বেরিয়ে কাছেই একটি শপিং মলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
মনটা বেশ ফুরফুরে। করোনা কালের গৃহবন্ধী জীবনে যখনি রাস্তায় বের হই খুব ভালো লাগে।
নিজের কাছে স্বাধীন স্বাধীন একটা ভাব আসে!
এই স্বাধীনতা ভোগ করতে প্রতিদিন রাস্তায় বের হতে চাই কিন্তু বেরসিক গিন্নি সে সুযোগ সহজে দিতে চায় না আমাকে! বাজার করতে বের হলে এমন ভাবে জিনিসের অর্ডার দেয় যাতে অন্তত ১৫ দিনে ঘর থেকে আর বের না হতে হয়।
তবে আমিও চালাক কম না! গিন্নির বলে দেয়া আইটেমের সবগুলো কিনিনা! অমুক অমুক জিনিস কেন আনি নাই জিজ্ঞেস করলে বলি স্যরি মনে ছিল না। তবে আমার উদ্দেশ্য ২/৩ দিনের মধ্যে আবার বের হওয়া। এভাবেই ঘর থেকে মাঝে মাঝে বের হচ্ছি।
যাক আজকের গল্পের প্রসঙ্গে আসি। উত্তরা ৪নং সেক্টরের একটা ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম আমার গন্তব্যের দিকে। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একজন বৃদ্ধ ভিক্ষুকের কাছে হাত বাড়িয়ে ৬/৭ বছরের দুজন বাচ্চা ছেলে কী যেন চাচ্ছে।
ওদেরকে যখন ক্রস করছিলাম তখন দেখলাম সেই ভিক্ষুক বাচ্চা ছেলে দুটির একজনকে ৫০ টাকা ও আরেকজনকে ২০ টাকার একটি নোট দিল। ভাবলাম পিতা তার দুই পুত্রের হাতে কিছু টাকা দিয়ে হয়তো বাসায় যেতে বলছে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সেই ভুল ভেঙ্গে গেল!
সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। পেছন থেকে কানে আসলো একজন বলছে ওরে ৫০ টাকা দিলেন আমারেও ৫০ টাকা দেন ২০ টাকা দিলেন কেন? এর উত্তরে ভিক্ষুক কী বলল তা আর শুনিনি কারণ ইতিমধ্যে আমি ওদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে চলে এসেছি।
কিছুদূর এগোতেই রাস্তার পাশে আম বোঝাই একটি রিকশা ভ্যান দেখতে পেয়ে দাঁড়ালাম। আম বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে লেংড়া ও হাঁড়িভাঙ্গা নামে দুই জাতের আম আছে তার কাছে। আমের নাম লেংড়া বা হাঁড়িভাঙ্গার মত উদ্ভট নাম কেন হলো জানি না! কে এই নাম দুটো রেখেছে তাও জানি না!
যাক হঠাৎই খেয়াল করলাম ভিক্ষুকের থেকে টাকা পাওয়া বাচ্চা ছেলে দুটো ভ্যানের কাছে এসে দাঁড়ালো। ভাবলাম ছেলে দুটোর সাথে কথা বলে মনের কৌতুহল দূর করি।
ওদেরকে দশ টাকার দুটো নোট দিয়ে বললাম তোমরা কি দুই ভাই?
না। আমরা এক বস্তিতে থাকি।
একটু আগে দেখলাম এক ভিক্ষুক তোমাদের দুজনকে ৫০ ও ২০ টাকা দিল। সে তোমাদের কী হয়?
হে আমাগো কিছু হয় না। হে ভিক্ষা করে। আমরাও ভিক্ষা করি।
ঐ ভিক্ষুক ওদের কিছু হয়না একথা শুনে অবাক হলাম। বললাম এই লোকের সাথে পরিচয় কিভাবে তোমাদের?
রাস্তায় দেখা হইতে হইতে পরিচয় হইছে।
সে নিজে একজন ভিক্ষুক হয়ে তোমাদেরকে এত টাকা কেন দিল?
হের অনেক টাকা। আমাগো মত আরো অনেক গরীব মানুষকে টাকা দেয়! হের ব্যাংকে আড়াই লাখ টাকা আছে।
তার ব্যাংকে যে এত টাকা আছে তোমরা কি করে জানলে?
হে কইছে!
যে ছেলেটিকে লোকটা ২০ টাকা দিয়েছে তাকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার বন্ধুকে ৫০ টাকা দিল কিন্তু তোমাকে সে ২০ টাকা দিল কেন?
আমার লগে পরশু দেখা হইছিলো সেদিন ৫০ টাকা দিছে। এর লাইগা আইজ ২০ টাকা দিছে। পাশের ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল সেদিন এই ছেড়া আমার লগে ছিল না।
বললাম তোমরা সত্যি কথা বলছো তো? তোমাদের কথা কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
বিশ্বাস না করলে চাচারে জিজ্ঞান।
উনাকে চাচা বল নাকি?
জ্বে।
চাচারে এখন কোথায় পাবো?
চাচারে কবরস্থানের সামনে পাইবেন এখন।
ছেলে দুটি চলে যেতে উদ্যত হলে ভ্যান থেকে দুটো আম ওজন করে ওদের দুজনকে দিলাম। ওরা চলে গেল।
বাসায় ফেরার তাড়া ছিলনা। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকে কবরস্থান ৭/৮ মিনিটের রাস্তা। তাই শপিং মলে না গিয়ে ওদের ভিক্ষুক চাচার খোঁজে সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
কবরস্থান পর্যন্ত যেতে হয়নি তার আগেই সেই ভিক্ষুকের দেখা পেলাম ফুটপাথের গাছের ছায়ার নিচে। ফ্লাক্সে চা বিক্রেতা এক হকারের পাশে বসে চা খাচ্ছে সে।
তার সামনে দাঁড়িয়ে দশ টাকা হাতে দিলাম। সে হাসি মুখে টাকাটা নিল। বললাম কিছু মনে না করলে আপনাকে কয়েকটি কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।
জ্বি করেন।
আপনি ভিক্ষা করেন কেন? শুনলাম আপনার নাকি অনেক টাকা আছে ব্যাংকে!
কার কাছে শুনলেন?
একটু আগে যখন দুটো বাচ্চা ছেলেকে টাকা দিচ্ছিলেন তখন আমি সেখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। সেই ছেলে দুটো আমাকে একথা বলেছে। ওরা বলল আপনার ব্যাংকে নাকি আড়াই লাখ টাকা আছে। ওদের কথা আমার বিশ্বাস হয় নাই। তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি।
ঠিক শুনছেন। তবে এখন বাড়ছে। তিন লাখ আছে ব্যাংকে। আর একটা মুদি দোকানে ৮০ হাজার টাকা জমা রাখছি।
কোন ব্যাংকে টাকা রাখেন?
সোনালী ব্যাংক। একথা বলে তার পাশে থাকা কাপড়ের ব্যাগটা দেখিয়ে বলল এইখানে জমা বই আছে।
ব্যাংকের কাগজপত্র বাসায় রাখেন না কেন?
বাসা তো নাই!
কোথায় থাকেন?
কাউলার একটা মসজিদে থাকি। সকালে বাইর হই আর রাইতে গিয়ে ঘুমাই।
মসজিদের গোসলখানা, টয়লেট ব্যবহার করতে দেয়?
দেয়। খাদেমকে দৈনিক ৫০ টাকা দেই। কোন কিছুর সমস্যা হয় না!
কতদিন ভিক্ষা করেন?
৫/৬ বছর।
এর আগে কী করতেন?
দেশের বাড়িতে ছিলাম।
দেশ কোথায়?
সিলেট।
আচ্ছা এত টাকা জমালেন কিভাবে?
গত রমজানে অনেক টাকা পাইছি। উত্তরার একজনেই এক লাখ টাকা দিছে। করোনা শুরু হওয়ার পর অনেক মানুষ টাকা দিতেছে।
আপনার দৈনিক আয় কত?
আয়ের ঠিক নাই। কোনদিন ২০০/৩০০শ। আবার কোনদিন দেড় দুই হাজার!
একটা কথা জানতে চাই। আপনি নিজে ভিক্ষা করেন। আবার অন্য মানুষকে ভিক্ষা দেন কেন?
স্বপ্নে দেখছি। স্বপ্নে একজন আমাকে বলছে দান খয়রাত করতে।
কে সে?
জানি না। সাদা পাগড়ি পড়া একজন লোক। ঘোড়ার উপরে দেখি উনারে! আবার মাঝে মাঝে আমার এক ছোট ভাইকে স্বপ্নে দেখি! সেও বলে!
ছোট ভাই কী মারা গেছে?
কয়েক বছর আগে সে মারা গেছে।
সে স্বপ্নে কী বলে?
বলে ভাই অনেক কষ্ট পাইতেছি। তুমি আমার নামে কিছু দান খয়রাত কর।
আপনার নাম কী?
ফুল মিয়া।
আচ্ছা ফুল মিয়া আপনার পরিবারের কথা তো কিছু বললেন না!
পরিবার নাই। বিয়া করি নাই।
বিয়ে করার ইচ্ছে হয় নাই কোনদিন?
একসময় ইচ্ছা হইছে। তবে তখন বউ পালনের টাকা ছিল না! এখন টাকা আছে কিন্তু ইচ্ছা নাই!
এসময় গিন্নির ফোন আসলো। বলল বাসায় আসবে কখন? রান্নার তেল নেই। তুমি আসলে রান্না শুরু করবো।
বললাম এখনি শপিং মলে রওনা দিব।
এখনো সেখানে যাও নাই? এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
ফুল মিয়ার সাথে গল্প করছিলাম!
কী এসব বলছো! সবসময় হেয়ালি করে কথা বল! কে এই ফুল মিয়া?
বাসায় এসে সব বলব। একথা বলে একটা রিকশা নিয়ে শপিং মলের দিকে যাত্রা করলাম।
যেতে যেতে ভাবতে লাগলাম আহারে আমাদের সব কোটিপতিরা যদি এমন স্বপ্ন দেখতেন!!!
Murshid Alam Hira
July 17, 2020