কিছু স্মৃতি, কিছু কথা ( ১ম পর্ব)
জাতীয় জীবনে শিক্ষার গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলে অভিহিত করা হয়েছে। শিক্ষাই জাতির উন্নতির পূর্বশর্ত। একথা মনে রেখে জাতিকে শিক্ষিত করে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে রূপ দিতে হবে। জাতীয় জীবন থেকে অনগ্রসরতা,দারিদ্র,কুসংস্কার ইত্যাদি দূর করার লক্ষ্যে দরকার ব্যপক শিক্ষার। আর শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রয়োজন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই কথা স্মরণে রেখে ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই হাজীগঞ্জে গুণীজন সুধিজন উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মোচনের লক্ষ্যে হাজীগঞ্জে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা ভাবনা করেন।
আজকের শাহারাস্তি তখন হাজীগঞ্জ থানার মাঝেই নিহিত ছিল। এই বিশাল এলাকার ছাত্র-ছাত্রীদের কলেজ পর্যায়ে অধ্যয়নের জন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছিল। সেই সুদূর পূর্বে লাকসাম কলেজ এবং পশ্চিমে মহকুমা সদরে চাঁদপুর কলেজ। যাতায়াতের মাধ্যম ছিল সকাল আটটায় হাজীগঞ্জ থেকে চাঁদপুরের ট্রেন এবং একই সময়ে লাকসামের ট্রেন। যারা এই ট্রেনে যাতায়াত করত তাদের ফিরতে হতো বিকেল চার টার ট্রেনে। এই দুরবস্থার মাঝে অনেক ছাত্র ছাত্রীর পক্ষেই এসএসসি পাশ করার পরে আর কলেজে ভর্তি হওয়া সম্ভব হতো না।
যার কারণে বৃহত্তর হাজীগঞ্জের ছাত্র-ছাত্রীরা লেখাপড়ায় কিছুটা পিছিয়ে থাকে। অনগ্রসরমান এই জনগোষ্ঠীর মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজনে ১৯৬৬ সনে জল্পনা কল্পনা শুরু হয় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার। কলেজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে যারা বাস্তবায়নের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন সেই গুণীজনেরা হলেন মরহুম আব্দুল মান্নান মিয়া, প্রাক্তন এমপি মরহুম আবদুর রব মিয়া, মরহুম আনোয়ার হোসেন মিয়া, মরহুম ডাক্তার আব্দুস সাত্তার (এমপি), মরহুম এমপি এম এ মতিন, মরহুম আলী আহমেদ চেয়ারম্যান, মরহুম সুজাত আলী মুন্সি, মরহুম তাফাজ্জল হায়দার চৌধুরী এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা বিএম কলিমুল্লাহ সহ আরো অনেকে।
যত প্রয়োজনই থাকুক না কেন, কলেজ প্রতিষ্ঠা তো ঐসময়ে অত সহজ ছিল না। কারণ, তখনো হাজীগঞ্জে ছিল উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমের মাঝে এক মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। স্থান নির্ধারণ এবং জমির প্রাপ্তির সমস্যাও ছিলো। অবশেষে সকল দ্বন্দ্বের অবসানকল্পে এগিয়ে আসেন মনিনাগ মজুমদার বাড়ির প্রাণ পুরুষ আলহাজ্ব সেকান্দর আলী মজুমদারের নেতৃত্বে পরিবারের আরো দশজন। তারা হলেন- আব্দুল মতিন মজুমদার, শামসুল হক মজুমদার, এস্কান্দার মিয়া মজুমদার, আবুল কাশেম মজুমদার, আবুল খায়ের মজুমদার, নুরুল ইসলাম মজুমদার, তাফাজ্জাল হোসেন মজুমদার, দেলোয়ার হোসেন মজুমদার, আলী হোসেন মজুমদার, জাকির হোসেন মজুমদার ও বাবু নন্দলাল সাহা ।
মজুমদার পরিবারের দানকৃত সম্পত্তির পরিমাণ পাঁচ একর। বাবু নন্দলাল সাহার দানকৃত সম্পদের পরিমান ১ একর ৩৩ শতাংশ। তাদের দানকৃত সম্পদের উপর ডাকাতিয়ার দক্ষিণ পাড়ে এক মনোরম পরিবেশে ১৯৬৯ সনে প্রতিষ্ঠিত হয় হাজীগঞ্জ কলেজ। যা পরবর্তীতে হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে রূপান্তরিত হয়। সর্বমোট ৬ একর ৩৩ শতাংশের উপর প্রতিষ্ঠিত কলেজটির উদ্বোধন করেন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক চাঁদপুরের জালালুদ্দিন সাহেব। কলেজ প্রতিষ্ঠার মাঝেই বাস্তবায়ন হয় হাজীগঞ্জের ইতিহাসের মহানায়কদের স্বপ্ন এবং দ্বার উন্মোচিত হয় হাজারো শিক্ষার্থীর উচ্চ শিক্ষার। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মরহুম সেকান্দর আলী মজুমদার সাহেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র জাকির হোসেন মজুমদার।
পর্যায়ক্রমে আরো কয়েকজন স্বনামধন্য ব্যক্তি কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। তাদের মাঝে উল্ল্যেখযোগ্য আবুল বাশার, শফিকুল ইসলাম, এইচ এম মহিউদ্দিন, মোহাম্মদ আলী, হাসান আলী এবং মোহাম্মদ ইউনুস অন্যতম। তৎকালীন অধ্যাপকদের মাঝে আজ ও যারা স্মরণীয় তাদের মাঝে উল্ল্যেখযোগ্য সাবেক কেবিনেট সেক্রেটারি আলী ইমাম মজুমদার, রফিকুল ইসলাম, অর্থনীতির আবুল হোসেন, লাকসামের জাহাঙ্গীর হোসেন, আব্দুল বাতেন, মাহাবুব রাব্বানী, মোস্তফা কামাল এবং ফরহাদ হোসেন রতন।
হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠায় ঐ অঞ্চলের ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণের কথা যদি কিছু না লিখি, তাহলে আমার এই লেখা অনেকাংশে অপূর্ণ থেকে যাবে। ওপারের যারা হাজীগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী ছিলেন, প্রত্যেকেই তাদের সাধ্যানুযায়ী অবদান রাখেন। আমি যতদূর জানি, এই কলেজ প্রতিষ্ঠায় রান্ধুনীমুড়ার মরহুম খলিল ব্যাপারীর অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। আরো স্মরণ করা যেতে পারে বিশিষ্ট গুড় ব্যবসায়ী মরহুম আব্দুল মতিন, মোখলেস মিয়া, ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন, মান্নান খান বাচ্চু, আনা মিয়া চেয়ারম্যান, মুদির জব্বার, জামাই মান্নান, টিন ব্যবসায়ী আমিন মিয়া, আব্দুর রব মেম্বার, রুহুল আমিন (মাইজ্জা মিয়া), মন্টু হাজী সহ আরো অনেক অনেক ছোট বড় ব্যাবসায়ীদের কথা। এই ছোট পরিসরে কলেজ প্রতিষ্ঠায় যারা অবদান রেখেছিলেন, তাদের সবার কথা উল্লেখ করতে না পেরে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
আর ওপারের সাধারণ মানুষদের অকুন্ঠ ভালোবাসা ও সহোযোগিতার প্রমাণ আমি কলেজে ১৯৭৯ সনে যোগদান করার পরেই উপলব্ধি করতে পেরেছি। তারা প্রত্যেকেই এই কলেজটিকে তাদের একান্ত নিজস্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে মনে করত এবং এই প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে আপন করে নিতেন। সাধারণ মানুষের এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি মমতা ও গভীর অনুভুতি যা কল্পনাকেও হার মানায়। কলেজ প্রতিষ্ঠার ঊষালগ্নে একটি রেওয়াজ চালু ছিল, দূরবর্তী অঞ্চল থেকে যারা এই কলেজে ভর্তি হত তাদের কলেজ সংলগ্ন বাড়িসমূহের প্রতিটি ঘরে একজন করে ছাত্রের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের। এভাবে এলাকাবাসীর ঐকান্তিক সহযোগিতায় ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে কলেজটি ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে। দিনে দিনে ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়।
উত্থান বিকাশ ও পতন ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়ম। হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ ও তার ব্যতিক্রম নয়। ১৯৬৯ এ প্রতিষ্ঠিত কলেজটির ৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে এসে কারনে অকারণে কিছুটা ছন্দপতন ঘটে। ফলশ্রুতিতে অনেক প্রতিভাবান শিক্ষক কলেজ ছেড়ে চলে যায় এবং ছাত্র সংখ্যাও দিনের পর দিন হ্রাস পেতে থাকে।
এমনই এক দুর্দিনে তৎকালীন কলেজ কর্তৃপক্ষ হাজিগঞ্জ হাই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক বাবু সুখলাল সাহাকে কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদান করেন। যা ছিল কলেজ কর্তৃপক্ষের সময়োপযোগী পদক্ষেপ। কলেজের হারানো গৌরবকে পুনরুদ্ধারকল্পে সুখলাল বাবু বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং তিনি বেশ কিছু শিক্ষক নিয়োগ দেন। তাদের মাঝে উল্ল্যেখযোগ্য অধ্যাপক শহিদুল্লাহ, রণজিত কুমার বণিক, আবিদ আলী ভুইয়া, জহিরুল ইসলাম চৌধুরী, আবু তাহের ভুইয়া, আবুল কালাম, সুনীল বাবু (খণ্ডকালীন), মহিবুর রহমান (খণ্ডকালীন) এবং আব্দুর রশিদ এমকম (খণ্ডকালীন) কে। শেষোক্ত দুইজন হাজীগঞ্জ হাই স্কুল এর শিক্ষক ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতা থেকে ১৯৭৯ সালে পহেলা অক্টোবর আমি হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে যোগদান করি এবং একই প্রতিষ্ঠানে এক নাগাড়ে ৩৫ বছর শিক্ষকতা করে ২০১৪ সালে অবসর গ্রহণ করেছি।
ইতিমধ্যেই যা কিছু লিখেছি তার সবই কলেজের নথি, প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত ব্যক্তি বর্গ এবং কলেজের সাথে আমার পূর্ববর্তী সময়ের সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে। আর এখন যা লিখব তার সবটুকুই আমার স্মৃতি হতে।
ছাত্রজীবনে কখনোই চিন্তা করিনি পেশা হিসেবে শিক্ষকতার কথা। জীবনে স্বপ্ন ছিল একজন আইনজীবী হওয়ার। এই প্রসঙ্গে বেশি কিছু লিখব না কারণ ইংরেজিতে একটি কথা আছে ‘Man proposes but God disposes’. এই উক্তিকেই আমার মা ভিন্নভাবে বলতেন, “আল্লাহর ইচ্ছাই বড়, বান্দার ইচ্ছা গড়”।
১৯৭৯ সনের জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পরিক্ষা সম্পন্ন করে অনেক স্মৃতি বিজড়িত আবাসিক হল (এ.এফ.রহমান) হল ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে আসি। ১৯৭৭ সালে একবার পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর পদে নিয়োগ পেয়েও মায়ের নিষেধাজ্ঞার কারণে যোগদান করিনি। কারণ আমার মা শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের ঘনিষ্ঠ সহচর আমার গ্রামের মরহুম হাফেজ আব্দুল মান্নান সাহেবের একান্ত অনুরাগী ছিলেন। উনার নিষেধাজ্ঞার কারণে মা আমাকে পুলিশ বাহিনীতে যোগদান থেকে বিরত রাখেন।
আমি বিশ্বাস করি এই নিষেধাজ্ঞাকে আমার বাকী জীবনের চলার পথের পাথেয় হিসেবে। অবকাশকালীন সময়ে বন্ধুবান্ধবদের সাথে ভালোই কাটছিল। ইতিমধ্যে নাসিরকোট কলেজের প্রিন্সিপাল কামাল উদ্দিন সাহেব, সিনিয়র শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান, প্রয়াত এসপি কুদ্দুস সাহেব, নাসিরকোট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম স্যার প্রমুখ আমাকে নাসিরকোট কলেজে যোগদান করার জন্য প্রস্তাব দেন। তাদের অতিরিক্ত পীড়াপীড়িতে আমি একদিন আমার এক বন্ধুকে নিয়ে নাসিরকোট কলেজে যাই। বিভিন্ন আলোচনার পরে এক সপ্তাহ পর আমি নাসিরকোট কলেজে যোগদান করতে সম্মত হই। কিন্তু নিয়তির খেলায় ইতিমধ্যেই হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে ইসলামের ইতিহাসের প্রভাষক আবিদ আলী ভুইয়া কৃষি ব্যাংকে যোগদান করায় এই পদটি শূণ্য হয়।
হাজীগঞ্জ কলেজে তৎকালীন কর্তৃপক্ষের আহবানে সাড়া দিয়ে আমি ১৯৭৯ সনের ৩০শে সেপ্টেম্বর বিকেলে কলেজ অধ্যক্ষের কার্যালয়ে অধ্যক্ষ বাবু সুখলাল সাহার কার্যালয়ে আবেদন পত্র সহ হাজির হই। সে এক অভূতপূর্ব অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা। যার বিস্তারিত দ্বিতীয় পর্বে ধারাবাহিক ভাবে লিখা হবে।
(দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন শনিবার সন্ধ্যায়, ধারাবাহিক লেখা পড়তে পপুলার বিডিনিউজ ডটকমের পেইজে লাইক দিয়ে রাখুন।)