স্মৃতির আয়নায় তাজু ভাই

অধ্যাপক মোজাম্মেল হক চৌধুরী মোহন
আপডেটঃ আগস্ট ১৮, ২০২০ | ৯:১০
অধ্যাপক মোজাম্মেল হক চৌধুরী মোহন
আপডেটঃ আগস্ট ১৮, ২০২০ | ৯:১০
Link Copied!

হাজীগঞ্জ সদর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক তাজুল ইসলাম পাটোয়ারী (তাজু ভাই) ইন্তেকাল করেন আজ থেকে পাঁচ দিন আগে। তারও পাঁচদিন আগে ইন্তেকাল করেন তার সহধর্মিণী। বাংলাদেশে করোনা আবির্ভাবের পরে করোনা আক্রান্ত হয়ে অনেক আপনজন মৃত্যু বরণ করেন। তার পরেও কেন জানি মনে হয় এই মৃত্যুটা একটু ব্যতিক্রম, অনেক হৃদয় বিদারক ও অনেক কষ্টের। সুস্থ-সবল, বলিষ্ঠ কন্ঠের এই মানুষটি এত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন তা অনেকের মত আমারো কল্পনার বাইরে ছিল। তাজু ভাইয়ের মত আরেকটি মৃত্যু আমার হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করেছিল। তা ছিল আমার প্রিয় সহপাঠী, সহযোদ্ধা, বন্ধুসম ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন মল্লিকের মৃত্যুর মতো। যেদিন ভোরবেলা আনোয়ার হোসেন মল্লিক মৃত্যু বরণ করেন ঐ দিনই সন্ধ্যায় তার সহধর্মিণীও মৃত্যু বরণ করেন। এ মৃত্যুটিও ছিল একটি হৃদয় বিদারক মৃত্যু।


যে জন্মাবে তাকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে- এ কথাটি চির সত্য। তারপরেও কিছু কথা থেকে যায়। তাজু ভাইয়ের মৃত্যুর পর প্রায় ত্রিশ জন আপন মানুষ মৃত্যুর খবরটি প্রচার করে। আমি সকলের প্রচারেই ইন্না লিল্লাহি পড়ি, কিন্তু আলাদাভাবে কোন প্রচার করি নাই। মনে মনে ভাবি, এই সজ্জন ব্যক্তিটি সম্পর্কে সুযোগ পেলে কিছু লিখব। এমনিতেই তো অবসর জীবনের একাকিত্বে প্রায়শই মানসিক ভাবে দূর্বল হয়ে পড়ি,অনেক আপনজনের সাথে সাক্ষাত তো দূরের কথা যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন।তার উপর আপনজনদের হারানোর সংবাদে হৃদয় ব্যথাক্রান্ত হয়ে রয়েছে। তাই, লিখতে গেলেও যেন কলম চলে না। আর আপনজনদের সম্পর্কে লিখতে গেলে হাত যেন অবশ হয়ে যায়৷ তারপরও লিখছি ৷

তাজু ভাই বয়সে আমার দুই বছরের ছোট। আমার ৬৫ বছর জীবনের তার সাথের অনেক কথা, অনেক স্মৃতি ও অনেক ঘটনা মনের মনিকোঠায় ভেসে উঠে। কিন্তু, আজকের লেখায় শুধু থাকবে একদিনের কিছু কথামালা।

চলতি বছরের প্রথম দিকে তাজু ভাই আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে একদিন আমাদের প্রিয় নেতা ইঞ্জিনিয়ার মমিনুল হক সাহেবের বাড়িতে আসেন। পড়ন্ত বিকেলে তিনি এবং মমিন ভাই দীর্ঘ সময় নিয়ে মমিন ভাইয়ের বাগান বাড়িতে পাশাপাশি হাঁটছিলেন। যেকোন একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকার কারণে ঐদিন মমিন সাহেবের বাড়িতে অনেক নেতাকর্মীর উপস্থিতি ছিল। তাদের কেউবা নিচ তলায় কেউবা দোতালায় কেউ বাগান বাড়িতে আবার কেউ ছিল মূল ফটকের সামনে, অনেক নেতাকর্মী। আমি কয়েকজনকে নিয়ে বসে ছিলাম বাগান বাড়ির প্রথম বড় গোল ঘরটিতে। পশ্চিম দিকে নজর করে দেখতে পেলাম তাজু ভাই এবং মমিন ভাই পাশাপাশি হাঁটছে তো হাঁটছেই। হাঁটার যেন কোন বিরাম নেই। কথারও শেষ নেই। আমরা অপেক্ষা করতে করতে কিছুটা অস্থির হয়ে উঠলাম। একজনের সাথে এত কি কথা। তাজু ভাইয়ের পরণে ছিল সেদিন সাদা পায়জামা ও সাদা পাঞ্জাবী। পায়ে ছিল চামড়ার স্যান্ডেল। আমাদের মূখ্য নেতা মমিন ভাইয়ের পরণে কি ধরনের পোশাক ছিল তা আমার মনে নেই। হাঁটার স্টাইল এবং পোশাক আশাকে ঐদিন মনে হয়েছিল তাজু ভাই মূখ্য নেতা। মাগরিবের নামাজের পূর্ববর্তী মূহুর্তে তিনি গোল ঘরে আমার পাশে এসে বসেন। নেতা কর্মীদের অনেকেই নামাজ পড়ার জন্য দোতালায় চলে যায়। আমরা কয়েকজন আলাদা আলাদা ভাবেই ঐ গোল ঘরেই চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করি, নামাজের পরে তাজু ভাইয়ের সাথে দীর্ঘ আলাপ হয়।

ঐ মূহুর্তে অনেকের মাঝে আমাদের সাথে ছিলেন অলিপুরের কানু পাটোয়ারী এবং মৈশাইদের জুলহাস। এক পর্যায়ে তাজু ভাই মনের অগোচরে বলে ফেলেন, ” আমি সামনের ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব, আপনাদের দোয়া এবং সমর্থন চাই।” আমি হেসে বলি,” কি ভাই, হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্ত?” প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, “আজীবন তো অন্যের জন্যেই করলাম এবার শেষ বয়সে একটু নিজের জন্য চেষ্টা করি।” এভাবে আরো অনেক কথা। সেসব আলোচনায় কানু পাটোয়ারীও অংশ নেয়। কানুও তো একজন সম্ভাব্য প্রার্থী। একবার সে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদন্দ্বিতাও করেছিল। সে অবশ্য তাজু ভাইকে অনুরোধের স্বরে বলেছিল,” ভাই আপনি হঠাৎ করে এ জাতীয় সিদ্ধান্ত নিবেন না। একবার আমাকে সুযোগ দিন। “এভাবে দীর্ঘ সময় কথা হওয়ার পরে কানু ও আমাদের থেকে বিদায় নেন, থাকি আমি আর তাজু ভাই সহ আরো দু-চারজন। আবার তাজু ভাই কথা বলা আরম্ভ করেন। আমেরিকার কথা, আমেরিকা প্রবাসী তার সন্তানদের কথা, গ্রামের কথা, ইউনিয়নের কথা ও রাজনীতির কথা। সে অনেক কথা।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু কে জানত, ঐদিনের কথা-ই ছিল তার আর আমার মাঝে সাক্ষাতে শেষ কথা। প্রবাসে সন্তানদের অবস্থানের কারণে তিনি অনেকবার আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বলেন, “ভাই, আমেরিকায় তো বেশি দিন থাকতে ভাল লাগেনা। ছেলেরা আসতে দেয় না। কিন্তু, এলাকার জন্য, এলাকার মানুষের জন্য আমি অস্থির হয়ে পড়ি, কখন ফিরে আসব। আমার অস্থিরতায় ছেলেরা অবশ্য জোর করত না।” কারণ ইতিমধ্যেই তিনি এলাকায় দেন, দরবার ও শালিসিতে পুরোদমে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আর মনের গহীনে সুপ্ত বাসনা ছিল সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হবার। অনেক আলাপচারিতার মাঝে তিনি তার বাড়িতে একটি বিল্ডিং তৈরির কথা ও বলেন। ঐসময়ে তিনি বাড্ডা গ্রামের বাড়ির চেয়ে হাজীগঞ্জ বাজারস্থ বাসাতেই বেশি থাকতেন এবং তার ভাবনা ছিল বাড়ির কাজ সম্পন্ন হলে গ্রামের বাড়িতেই স্থায়ী ভাবে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিবেন। কিন্তু কে জানত, বাকী জীবনটা ছিল তার একেবারেই সংক্ষিপ্ত সময়ের।

হাজীগঞ্জ সদর ইউনিয়নের বাড্ডা গ্রামের পাটোয়ারী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করা তাজুল ইসলাম পাটোয়ারী পাঁচ পুত্র এবং দুই কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। তার তিন পুত্রই আমেরিকা প্রবাসী। ছাত্রনেতা দিপু পাটোয়ারী ও কনিষ্ঠ সন্তান সহ তাজু ভাই দেশে থাকতেন। দুই কন্যা সন্তানকে ইতোমধ্যেই সু-পাত্রে পাত্রস্থ করেন। পারিবারিকভাবে তিনি একজন সুখী মানুষই ছিলেন। অনেক বড় শিক্ষিত না হলেও তিনি ছিলেন একজন জ্ঞানী, বিচক্ষণ ও স্পষ্টবাদী মানুষ। যেকোন ব্যাপারে সামনা সামনি কথা বলাই ছিল তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। বয়সে মাত্র দু’বছররে ছোট হয়েও তিনি আমাকে সম্বোধন করতেন কখনো স্যার, কখনো বড় ভাই, কখনো চৌধুরী সাহেব কিংবা কখনো প্রফেসর সাহেব। তার এই বিনয়ী ভাষার জন্য মাঝেমাঝে আমি বিব্রতবোধ করতাম। সত্যি তিনি একজন সজ্জন ব্যাক্তি ছিলেন। মৃত্যুর আগ মুহুর্তেও তিনি জেনে যেতে পারেননি তার সহধর্মিণী তার মৃত্যুর পাঁচদিন আগেই এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। তার সহধর্মিণীর মৃত্যুর দুদিন আগে আমি তার পুত্র দীপুকে টেলিফোন করে তাদের সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। পারিবারিকভাবে ঐসময়ে অনেকেই অসুস্থ ছিলেন। এ খবরটি আমি জানতে পারি মমিন ভাইয়ের কাছ থেকে। ফেসবুকে দেখেছিলাম তাজু ভাই অসুস্থ এবং তিনি ল্যাব এইড হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি রয়েছেন। দীপুর সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারলাম তাজু ভাইয়ের পাশাপাশি দীপুর মা ও ল্যাব এইডে ভর্তি। দীপু আরো জানালো,”আব্বুর অবস্থা এখন অনেকটাই ভালো, কিন্তু মায়ের অবস্থা বেশি ভালো নেই। ” আমাদেরকে হাসপাতালে না এসে মা-বাবার জন্য দোয়া করতে বলল।

এই কথোপকথনের দুইদিন পরেই দীপুর মা হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তাজু ভাইয়ের আরো অসুস্থ হওয়ার ভয়ে এই সংবাদটি গোপন রেখেই মাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসে বাড্ডা গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। এও ছিল তাজু ভাইয়ের অজানা এবং মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত তা অজানাই ছিল। এ এক মর্মস্পর্শী ও হৃদয় বিদারক ঘটনা।

শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ মানুষের চরিত্রের অলংকার। সুন্দর আদব কায়দা মানুষের জীবনের পরম সম্পদ। জীবনকে যথার্থভাবে বিকশিত করা এবং যথার্থভাবে উপভোগ করার জন্য শিষ্টাচার অপরিহার্য। তাজুল ইসলাম পাটোয়ারী (তাজু ভাই) তার চমৎকার আচার আচরণ, বিনম্র ব্যবহার, সততা এবং সৌজন্যবোধ এর জন্য অনেকদিন আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় চির জাগরুক হয়ে থাকবেন। তারপরও তিনি তো একজন মানুষ ছিলেন। ব্যক্তি জীবনে, সমাজ জীবনে তার ভুল ত্রুটির জন্য আমরা যারা তার সুহৃদ, আপনজন সবাই মিলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে ক্ষমা চাই, দোয়া করি রাব্বুল আলামীন যেন মরহুম-মরহুমাকে ক্ষমা করে জান্নাতবাসী করেন, তার পরিবারের অসুস্থদের সুস্থতা দেন এবং শোকের সাগরে নিমজ্জিত পরিবার পরিজনদের এই শোক সইবার শক্তি দান করেন। আমিন আমিন আমিন।

জুলহাস চৌধুরী-২

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্ট সংবাদ:

ট্যাগ:

শীর্ষ সংবাদ:
সারাদেশে দুই লাখ আনসার মোতায়েন হচ্ছে দেশে এখন নির্বাচনের চেয়ে সংস্কার জরুরি: জামায়াত প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে সংলাপে বসেছে বিএনপি টানা বৃষ্টিতে ফের ডুবছে নোয়াখালী, পানিবন্দি ১২ লাখ মানুষ হাজীগঞ্জে শিক্ষক দিবসে আলোচনা সভা ও র‌্যালি হাজীগঞ্জে দুর্গাপূজা উপলক্ষে মতবিনিময় সভা মোংলায় ১০ গ্রেড বাস্তবায়নে শিক্ষকদের মানববন্ধন  কচুয়ায় বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত  চাঁদপুরে বেড়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ, হাসপাতালে ভর্তি অর্ধশত  টানা বৃষ্টিতে হাজীগঞ্জে জলাবদ্ধতায় পানি বন্দি মানুষ  চাঁদপুরে দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড, জেলাজুড়ে জলাবদ্ধতা হাজীগঞ্জে বিদ্যুতায়িত হয়ে রাজমিস্ত্রির মৃত্যু কুমিল্লায় ট্রেনে কাটা পড়ে কলেজছাত্রের মৃত্যু ব্যারিস্টার টিপুকে হত্যা চেষ্টায় মতলব উত্তরে সাবেক মন্ত্রী পুত্র, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রের বিরুদ্ধে মামলা ফরিদগঞ্জে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১০৮ শিক্ষার্থীকে পাঠদান দিচ্ছে একজন শিক্ষক দ্বারা! বাজারে সবজির দাম আকাশছোঁয়া বিকল্প কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে জেলেদের মাঝে বকনা বাছুর বিতরণ এইচএসসি পরীক্ষার ফল ১৫-১৭ অক্টোবরের মধ্যে বিশ্বকাপ খেলতে নেমেই নতুন রেকর্ড গড়লেন জ্যোতি ‘আয়নাঘরের’ প্রমাণ পেয়েছে গুম কমিশন, জমা পড়েছে ৪০০ অভিযোগ