চায়ের কদর করোনাকালে
প্রতিদিন দু’চার কাপ চা পান করতে কে না ভালোবাসেন? শত ব্যস্ততার মাঝে, ক্লান্তিতে অথবা আলসেমিতে, গল্পে-আড্ডায়, বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নে কিংবা অফিসের ব্যস্ততায় এবং সাধারণভাবে দিনের যে কোনো সময় চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতে ভালোবাসেন না এমন মানুষ খুব কমই আছেন। অনেকে তো এক কাপ চা পান না করে সকালটা শুরুই করতে পারেন না। কারণ এক কাপ চায়ের সঙ্গে দিনের শুরুটা যেমন সুন্দর হয়, তেমনি সারা দিনের কাজের মাঝে এক কাপ চা শরীরের সব ক্লান্তি দূর করে দেয়।
মানুষের রুচির ফারাকের শেষ নেই। চায়ের পদ আর বানানোর পদ্ধতিরও ইয়ত্তা নেই। কারও পছন্দ কড়া চা, কারও হালকা লিকার, কারও রং চা তো কারও দুধ-চিনি ছাড়া চা মুখেই রোচে না। কম-বেশি সব ধরনের চায়েই রয়েছে নানা উপকারিতা। করোনাকালে কণ্ঠনালি ও ফুসফুস সুরক্ষিত রাখতে গরম পানি এবং চা পান করার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। ভেষজ উপাদানে তৈরি চা সে ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর। চায়ে রয়েছে অনেক বেশি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা হƒদরোগের ঝুঁকি কমায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। শুধু তা-ই নয়, চা রক্ত জমাট বাঁধাও দূর করে। চলুন জেনে নেয়া যাক নানা রকম চা ও তার উপকার সম্পর্কে-
কালো চা বা ব্লাক টি বা রং চা
কালো চা বা ব্ল্যাক টি সাধারণত রং চা নামেই বেশি পরিচিত। পুরোপুরি গাঁজন করার পর ছোট ছোট দানাদার এ চা খাওয়ার উপযোগী হয়। রং চায়ে ক্যালরির পরিমাণ অনেক কম থাকে। রং চায়ের কিছু উপাদান শরীরের ক্লান্তি দূর করার পাশাপাশি হার্টের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়, ক্যান্সার প্রতিরোধ করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটায় ও স্ট্রেস কমায়।
সবুজ চা বা গ্রিন টি
চা গাছের সবুজ পাতা রোদে শুকিয়ে তাওয়ায় সেঁকে চা প্রস্তুত করা হয়। এটি একেবারেই গাঁজন করা হয় না। ওজন কমাতে গ্রিন টির গুণের কথা কারও অজানা নয়। এতে রয়েছে উচ্চহারে ক্যাফেইন, যা আপনার স্মৃতিশক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে। তাছাড়া খাদ্যনালির ক্যান্সার প্রতিরোধে, শরীরের খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে হৃদরোগ প্রতিরোধ করে গ্রিন টি। নিয়মিত এ চা পান করলে আপনার ত্বক থাকবে টান টান সতেজ।
দুধ চা
অনেকে স্বাদের জন্য চায়ে দুধ-চিনি মিশিয়ে খান। এ চায়ে উপকার তেমন একটা নেই। বরং রয়েছে নানারকম ক্ষতিকর দিক। চায়ে দুধ মেশালে চায়ের শরীরের রক্তনালি প্রসারণের ক্ষমতা একেবারেই চলে যায়। ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে ইনসুলিন নির্গত হওয়া জরুরি; কিন্তু চায়ে দুধ মেশালে এ ইনসুলিন নির্গমনের হার কমতে থাকে।
মজাদার মসলা চা
আদা, এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, কালিজিরাসহ বিভিন্ন রকম মসলা দিয়েও চা তৈরি করা হয়। মসলা চা খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি শরীরের জন্য অনেক বেশি উপকারী। এর মধ্যে রয়েছে :
এলাচ চা
এলাচ চায়ে রয়েছে নানা গুণ। এলাচ চা হজমে সহায়ক, মাথাব্যথা কমানো, ঠাণ্ডাজনিত সমস্যায় নিয়মিত পান করতে পারেন এলাচ চা। এটি অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল; যা আপনার চামড়ার ওপরে নানা আঘাত বা ক্ষতকে দ্রুত সারিয়ে তুলতে এবং রক্ত সঞ্চালনে সহায়ক এলাচ চা।
লবঙ্গ চা
লবঙ্গে বিদ্যমান ইউজিনল শ্বাসতন্ত্র ও সাইনাসে জমে থাকা শ্লেষ্মা বের করে দিয়ে আরাম দেয় এবং দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করে। জ্বরের সময় শরীরের তাপমাত্রা কমাতে সহায়ক লবঙ্গ চা।
লেবু চা
গলাব্যথা, মাথাব্যথা, শরীরব্যথা, সর্দি, ফ্লু, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ঠাণ্ডাজনিত অসুস্থতায় লেবু চা হতে পারে কার্যকর। এ ছাড়া প্রদাহ হ্রাস ও হজমশক্তি বৃদ্ধিসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করে লেবু চা।
আদা চা
রং চায়ের সঙ্গে আদা মিশিয়ে পান করলে নানা উপকার পাওয়া যায়। যে কোনো ব্যথা কমাতে উপকারী আদা চা। হাঁপানি, সর্দি, কাশি, বমি বমি ভাব, ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ, শরীরের প্রদাহ কমানো ইত্যাদি স্বাস্থ্য সমস্যা নিরাময়েও উপকারী আদা চা।
ফুলের চা
সাধারণ চায়ের চেয়ে নানা রকম ফুলের চায়ে রয়েছে অনেক বেশি উপকারিতা। বিভিন্ন রকম ফুলের চায়ের মধ্যে রয়েছে-
জবা ফুলের চা
জবা ফুল দিয়ে বানানো চা খেলে আমাদের হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। জবা ফুলের চায়ে থাকা বিশেষ কিছু উপাদান আমাদের শরীরে অ্যামিলেস নামক একটি উপাদানের উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এর ফলে আমাদের ওজন কমে। জবা ফুলের চা আমাদের শরীরে ক্ষতিকর কলেস্টরলের মাত্রা কমায়, ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে ও ভিটামিন ‘সি’-এর ঘাটতি মেটায়।
লাভেন্ডার চা
এ ফুল শুধু দেখতেই সুন্দর তা নয়; এর অ্যাসেনশিয়াল অয়েল উৎকণ্ঠা, ব্যথা, মাইগ্রেন ও স্ট্রেসের সমস্যা দূর করতে অত্যন্ত উপকারী।
অপরাজিতা চা
পান করতে পারেন নানা গুণে সমৃদ্ধ অপরাজিতা ফুলের চা। মূলত এ চা সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ধারণা নেই। অথচ এর রয়েছে অনেক ঔষধি গুণ। অপরাজিতা ফুলের চা ‘নীল চা’ নামে বেশি পরিচিত। গরম পানিতে কয়েকটি ফুল দিয়ে সেদ্ধ করে পান করতে পারেন অপরাজিতা চা। এর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল অম্লত্ব বা ক্ষারত্বের ওপর ভিত্তি করে এর রং বদলায়। যদি এতে লেবুর রস যোগ করেন, তাহলে এটি বেগুনি রং ধারণ করবে। এ চায়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, লিভার সুরক্ষা, ক্যান্সার প্রতিরোধ, অ্যাজমা প্রতিরোধ, স্মৃতিশক্তি বাড়ানোসহ নানা উপকার রয়েছে।
ভেষজ চা
রোগ প্রতিরোধ ও শরীর চাঙ্গা করতে জুড়ি নেই ভেষজ চায়ের। আয়ুর্বেদীয় ভেষজ চা তৈরিতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় গুড়, মধু, এলাচ, দারুচিনি, গোলমরিচ, লবঙ্গ, তেজপাতা, শুকনো আঙুর, তুলসীপাতা, পুদিনাপাতা, আদা ও লেবু। ভেষজ চায়ের মধ্যে উৎকণ্ঠায় ভোগা এবং মস্তিষ্কের কোষ সুস্থ রাখতে সাহায্য করে তুলসী চা। রং চায়ে পুদিনাপাতা দিয়ে খেলে তা পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমে ভোগা মহিলাদের শরীরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ রাখতে সাহায্য করে। এ ছাড়া জেসমিন চা, জাফরান চা, জিরা চা, এলাচ চা, ক্যামোমিল চা। এগুলোতে মূলত ক্যাফেইন থাকে না।
সংক্রমণে উপকারী ভেষজ চা
করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা খুব জরুরি। আর এ সময় ভেষজ চা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে অনেকটাই সহায়ক হবে। শরীরের ইমিউনিটি শক্তিশালী করতে দিনে ৩-৪ বার এ চা পান করুন।
চা বারবার, কিন্তু কতবার?
কোনো কিছুই অতিরিক্ত ভালো নয়, তবে দিনে চার-পাঁচ কাপ চা নির্দ্বিধায় খেতে পারেন। অবশ্যই তা যদি হয় গ্রিন টি, রং চা কিংবা ভেষজ চা।